

এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপে সবচেয়ে বিপর্যস্ত রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত এ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ৩১৪ জন রোগী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, সরকারি ৫৮টি ডেঙ্গু চিকিৎসা কেন্দ্রের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী ভর্তি হওয়া প্রতিষ্ঠান।
মুগদা হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের ভাষ্য, রোগীর অতিরিক্ত চাপ সামলাতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
মঙ্গলবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ডের ভেতরে জায়গার অভাব এতটাই, বারান্দা ও খোলা জায়গাতেও বিছানা পেতে রোগীদের রাখা হয়েছে। ছাদে সংযুক্ত ফ্যানগুলো দূরে দূরে থাকলেও মানুষের ভিড়ে ভ্যাপসা গরম। অষ্টম তলায় শিশু ওয়ার্ডে ৪৬ জন এবং ১১ তলায় নারী-পুরুষ মিলে ১০৬ জন রোগী ভর্তি। প্রতিটি শয্যার পাশে ঝুলছে স্যালাইনের ব্যাগ, রোগীদের সঙ্গে আছেন অভিভাবক ও আত্মীয়রা। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের সঙ্গে পরিবারের একাধিক সদস্য থাকায় ওয়ার্ডে হাঁটার জায়গাও নেই।
রক্ত পরীক্ষার নমুনা দিতে গিয়েও রয়েছে ভোগান্তি। প্যাথলজি বিভাগের সামনে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা আব্বাস উদ্দিন নামে এক রোগী জানান, গুরুতর রোগীদের ওয়ার্ড থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হলেও অধিকাংশ রোগী নিজেরাই দোতলায় এসে লম্বা লাইনে দাঁড়ান। এতে এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছেন মান্ডা, বাসাবো, খিলগাঁও এবং যাত্রাবাড়ী থেকে। আগে ঢাকার বাইরের রোগী বেশি এলেও এখন রাজধানীর রোগীই বেশি।
হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম সত্যের পথে বলেন, ‘চলতি বছর ডেঙ্গুতে আমাদের এখানে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর বেশির ভাগই ঢাকার বাইরের বাসিন্দা। তবে এখন ঢাকার রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।’
মুগদায় তুলনামূলক কম খরচে চিকিৎসা হওয়ায় আশপাশের অনেক হাসপাতাল ছেড়ে রোগীরা এখানে ভিড় করছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা গাড়িচালক হাসান বলেন, ‘আমার এলাকার অনেকেই মুগদায় চিকিৎসা নিয়েছেন, তাই আমিও এখানে এসেছি।’
দাউদকান্দি থেকে আসা রিমি (১৬) ভর্তি আছে ৯ দিন ধরে। তার মা জুলিয়া বেগম বলেন, মেয়ের পেটে পানি এসেছে, রক্ত দেওয়ার পরও প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। খরচ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বরগুনা থেকে আসা ১৫ বছরের ফেরদৌসের বাবা আতিক হোসেন জানান, রক্তের ব্যবস্থাই বড় চ্যালেঞ্জ, তার ওপর চিকিৎসার খরচ।
গৃহকর্মী চম্পা বলেন, মেয়ের ডায়রিয়া শুরু হওয়ায় হাসপাতাল থেকে ছুটি দেয়নি। এরই মধ্যে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে।
হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সত্যজিৎ সাহা বলেন, এবার রোগীরা জ্বর হওয়ার দুই দিনের মধ্যেই পরীক্ষা করে ভর্তি হচ্ছেন। তবে অনেকেই উপসর্গ না থাকলেও ভয়ে ভর্তি হচ্ছেন। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে শক সিনড্রোম।
তিনি জানান, শুধু প্লাটিলেট কমে যাওয়া ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কারণ নয়। রোগীর প্লাটিলেট ১০ হাজারের ওপরে ও রক্তপাত না থাকলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তাঁর মতে, এই বছর শক সিনড্রোমের হার বেশি দেখা গেছে। গত বছরের তুলনায় রোগীর সংখ্যা কিছুটা কম হলেও সেপ্টেম্বরের পর থেকে হঠাৎ বেড়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত সোমবারের তথ্য বলছে, এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৫ হাজার ৪১৬ জন। মারা গেছেন ২৩৩ জন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদেরা আগেই সতর্ক করেছিলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ থেকে বলা হয়েছে, মুগদার আশপাশের এলাকা ডেঙ্গুতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। এখন রোগটির প্রকোপ দেখে ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশি হচ্ছে, এমন এলাকায় বাড়ি বাড়ি অভিযান চালানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, এ মুহূর্তে ডেঙ্গু প্রতিরোধে আক্রান্ত এবং মৃতদের ঠিকানা বিশ্লেষণ করে মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা দক্ষিণের যেসব এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছেন, সেখানে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ঢাকায় মারা যাওয়া অনেক রোগী বাইরে থেকে আসা।
ডেঙ্গুতে এক দিনে প্রাণ হারালেন আরও পাঁচজন
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর মশাবাহিত এই রোগে প্রাণ হারালেন ২৩৮ জন। পাঁচজনের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও দুজন নারী। তাদের মধ্যে দুজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বাকি তিনজন মিটফোর্ড, মুগদা মেডিকেল কলেজ ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
একই সময়ে নতুন করে ৮৪১ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ২৫৭। বর্তমানে দেশে দুই হাজার ৬৬৫ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন; ঢাকার হাসপাতালে ৯৭১ জন, বাকিরা ঢাকার বাইরে।
সেপ্টেম্বর মাসে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৮৬৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ওই মাসেই মারা গিয়েছিলেন ৭৬ জন। চলতি অক্টোবরের প্রথম ১৪ দিনে আট হাজার ৯১৫ জন ভর্তি হয়েছেন এবং ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে।




