[caption id="attachment_9122" align="aligncenter" width="600"]
রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়ির পোশাক কারখানা আরএন ফ্যাশনসে কাজ করেন আলআমিন। রান্না না হওয়ায় সকালে না খেয়ে কাজে যান। আগুন লাগার খবর পেয়ে ছেলের খোঁজে ছুটে আসেন মা। সন্ধান না পেয়ে অজানা শঙ্কায় ছবিতেই ছেলের স্পর্শ খুঁজছিলেন তিনি। মঙ্গলবার বিকেলে তোলা মাহবুব হো[/caption]
রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে একটি পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার শিয়ালবাড়ি এলাকার এ ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। দগ্ধ ও আহত হয়েছেন অনেকে।
নিহত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ। আগুনে সবার দেহ এতটা অঙ্গার হয়েছে যে, চেনার উপায় নেই। অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কেও তাৎক্ষণিক তথ্য দিতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। তবে তারা বলছে, কারখানা ও গুদামে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি পোশাক কারখানার ছাদে যাওয়ার দরজায় দুটি তালা লাগানো ছিল।
এত বেশি প্রাণহানির বিষয়ে প্রাথমিক কারণ হিসেবে ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, কারখানার পাশে থাকা রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণের পর সেখান থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া বা টক্সিক গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে, ছিল প্রাণঘাতী।
২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলী ও ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের সময় লোকালয়ে রাসায়নিক গুদাম থাকায় ঝুঁকির বিষয় বড় আকারে আলোচনায় এসেছিল।
গতকাল ১৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফেসবুক পোস্টে গভীর শোক জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ও স্বচ্ছ পদক্ষেপের মাধ্যমে তদন্ত করে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিয়ালবাড়ির চারতলা ভবনে আনোয়ার ফ্যাশন নামে পোশাক কারখানায় আগুন লাগে। এরপর পাশে থাকা টিনশেড ঘরে রাসায়নিকের গুদাম পর্যন্ত পৌঁছালে আগুনের ভয়াবহতা বাড়ে। ১১টা ৪০ মিনিটে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন।
বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম প্রথমে ৯ জনের মৃত্যুর তথ্য জানান। সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে সংখ্যাটি ১৬ জানায় ফায়ার সার্ভিস।
ঘটনাস্থলে দেখা যায়, ছবি হাতে অনেককে খুঁজছেন স্বজনরা। তাদের কান্না ও আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে রূপনগরের পরিবেশ। স্বজনকে খুঁজে না পেয়ে অনেকের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ।
ঘটনাস্থল ঘিরে ছিল উৎসুক জনতা ও স্বজনের ভিড়। এক পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ভবনটি ঘিরে রাখেন। বিকেল ৫টার দিকে একে একে বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ভবনে ঢোকে। স্বজনদের মধ্যে নতুন করে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। রাতে সব মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পোশাক কারখানার নিচতলায় ছিল ওয়াশিং ইউনিট। সেখানে প্রথম আগুন লাগে। এরপর তা পাশের রাসায়নিকের গুদামে ছড়িয়ে পড়লে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। মুহূর্তে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
পোশাক কারখানায় কাজ করতেন ২০ বছর বয়সী রবিউল্লাহ। সকাল থেকে তাঁর খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। রবিউল্লাহর ভাই হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘যার কাছে যাচ্ছি, কেউ কিছু বলতে পারছে না। শুনেছি, তৃতীয় ও চতুর্থ তলা থেকে কেউ বের হতে পারেনি। ওই দুই ফ্লোরে শতাধিক শ্রমিক কাজ করতেন।’
সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে এসে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। এ পর্যন্ত আমরা ১৬ মরদেহ পেয়েছি। প্রচণ্ড তাপে তাদের মুখসহ শরীর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। পরিচয় শনাক্ত সম্ভব হচ্ছে না। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত হতে হবে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার মাঝখানে সবাই আটকা পড়েছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। রাসায়নিক বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট বিষাক্ত গ্যাসের কারণে তারা অচেতন হয়ে মারা যান।
স্থানীয় শ্রমিক ও বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, গুদামে ছয়-সাত ধরনের রাসায়নিক ছিল। ব্লিচিং পাউডার, পটাশ, এনজাইম, লবণ, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ছিল বলে জানা গেছে। তিনি বলেন, পোশাক কারখানার চারতলার ওপরে টিনশেড। এটি পাশে চাটাই দিয়ে ঘেরা। চারতলার ছাদের গ্রিলের দরজা তালা মারা ছিল। ফলে চারতলার ছাদে গিয়ে কেউ আত্মরক্ষার চেষ্টাও করতে পারেননি।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, কারখানা অংশের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। রাসায়নিক গুদামের আগুন এখনও (রাত দেড়টা) নিয়ন্ত্রণ আসেনি। ১২ ইউনিট কাজ করছে। কারখানা ও গুদামে কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না।
আনোয়ার ফ্যাশনসের পেছনে তিনতলা ভবনেও একটি ওয়াশিং প্লান্ট রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মো. রাজীব জানান, আগুন লাগার পরপরই তাদের ভবনের ছাদ থেকে পোশাক কারখানা ভবনের চতুর্থ তলার দেয়াল ভেঙে দেন। সেখান থেকে ছয়জন বেরিয়ে আসেন। আগুনে ভবনের সামনে থাকা তিনটি মোটরসাইকেল ও একটি কাভার্ড ভ্যান পুড়ে যায়।
এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর রাত সোয়া ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল সাংবাদিকদের বলেন, বারবার নির্দেশনার পরও রাসায়নিক গুদাম স্থাপনে নিরাপত্তা সতর্কতা মানা হচ্ছে না। আমরা এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। ভবনটির কাঠামো দেখে মনে হচ্ছে, নির্মাণে কোনো বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। আজ বুধবার বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। রাত ১২টার দিকে আসেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক। পরে রিজভী সাংবাদিকদের বলেন, নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে বিএনপির পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা দেওয়া হবে। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক বিষয়টি সমন্বয় করবেন। বিএনপি সরকার গঠন করলে আবাসিক এলাকায় শিল্পায়নসহ সমন্বয়হীনতার ঘাটতি দূর করতে কাজ করবে।
স্বজনের আহাজারি, উৎকণ্ঠা
নিখোঁজদের সন্ধান পেতে ছবি হাতে ঘটনাস্থলে অপেক্ষা করছেন স্বজনরা। এমনই একজন রেশমা আক্তার সত্যের পথেকে বললেন, ছোট বোন আসমা আক্তার (১৫) পোশাক কারখানায় কাজ করত। আগুন লাগার পর থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
নারগিস আক্তারের খোঁজে আসা বড় বোন লাইজু বেগম বলেন, সকাল পৌনে ৮টায় বোন কাজে আসে। আগুন লাগার পর সেখানকার একজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানতে পারি, কেউ ভেতর থেকে বের হতে পারেনি।
ভাগনি সুলতানা ও তাঁর স্বামী জয়ের ছবি হাতে ঘুরছেন ইয়াসিন। তিনি বলেন, দুজনই তিন দিন আগে কাজ নেয়। সকালে একসঙ্গে কাজে আসে। আগুন লাগার পর ফোন করে ভেতরে আটকে পড়ার কথা জানায়। এখন খোঁজ পাচ্ছি না; মোবাইল নম্বরও বন্ধ।
নিখোঁজ মাহিরার মামা শফিকুল ইসলাম বলেন, আমার ভাগনি তিনতলায় কাজ করত। আশপাশের হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছি, কোথাও পাইনি।
বন্ধু সারোয়ারের ছবি হাতে ঘুরছেন আমানুল্লাহ। তিনি বলেন, সারোয়ার ওয়াশিং ইউনিটে হেলপারের কাজ করে। অল্প কয়েক দিন হলো চাকরি নিয়েছে। আগুন লাগার পর থেকে তার সন্ধান পাচ্ছি না।
স্থানীয়রা জানান, রাসায়নিক গুদামের মালিক স্থানীয় বাসিন্দা শাহ আলম। পোশাক কারখানার মালিক হিসেবে একাধিক নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম রাজীব মিয়া ও নজরুল ইসলাম।
প্রতিষ্ঠানটি বিজিএমইএর সদস্য নয়
আগুনে পুড়ে যাওয়া পোশাক কারখানা বিজিএমইএর সদস্য নয় বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। গতকাল বিজিএমইএর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শিয়ালবাড়িতে যে কারখানায় আগুন লেগেছে, তা বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত কোনো পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি ওয়াশিং কারখানা। তবে হতাহতের ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ ও আহতদের সুস্থতা কামনা করেছে বিজিএমইএ।