[caption id="attachment_10446" align="alignnone" width="600"]
কোল্ড স্টোরেজে আলু বাছাই করছেন শ্রমিকেরা । ফাইলছবি সত্যের পথে[/caption]
কয়েক বছর ধরে আলু চাষ করে মুনাফা করতে পারছেন না কৃষক মো. উসমান গণী। কখনো লোকসান গুনতে হচ্ছে, কখনো খরচটাই শুধু উঠছে। তাই আগামী নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া মৌসুমে তিনি আগের চেয়ে কম জমিতে আলু চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
চন্দনাইশ উপজেলার বাসিন্দা উসমান গণী সত্যের পথেকে বলেন, তাঁর দেড় কানি জমি রয়েছে। গত বছর প্রায় ৩০ শতক জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। প্রতি শতকে গড়ে তিন মণ করে আলু পেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্রি করে মুনাফা হয়নি। তিনি বলেন, ‘এবার ৫ থেকে ৬ গন্ডা জমিতে আলু করব। গতবার রোগবালাই আর পোকার আক্রমণে অনেক আলুই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।’
শুধু উসমান গণী নন, তাঁর মতো চট্টগ্রাম জেলার শতাধিক কৃষক কয়েক বছর ধরে আলু চাষ করে লাভের মুখ দেখেননি। ফলে তাঁরা ধীরে ধীরে আলু চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন—এমন তথ্য মিলেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে।
❝
সর্বশেষ মৌসুমে দেশে আলুর উৎপাদন চাহিদার তুলনায় প্রায় ৪০ লাখ টন বেশি হয়েছিল। ফলে দাম পড়ে যায়। মাঠপর্যায়ে কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য পাননি। তাই অনেকেই এখন আর আগ্রহী নন। এ কারণে এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও বাড়ানো হয়নি
মো. ওমর ফারুক, অতিরিক্ত উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামে সাধারণত ডায়মন্ড, কার্ডিনাল, দোহাজারীর স্থানীয় জাতসহ কয়েক জাতের আলুর চাষ হয়। ডায়মন্ড বা বারি-৭ ও কার্ডিনাল বা বারি-৮ জাতের আলুর উৎপত্তিস্থল নেদারল্যান্ডস। ‘দোহাজারী’ চট্টগ্রামের স্থানীয় জাত। বহু বছর আগে দোহাজারীতে এ আলুর চাষ শুরু করেছিলেন কৃষকেরা। সাধারণত নভেম্বরের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে এসব জাতের বীজ রোপণ করা হয়। আর ফলন ওঠাতে হয় ৯০ থেকে ৯৫ দিনের মধ্যে।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘সর্বশেষ মৌসুমে দেশে আলুর উৎপাদন চাহিদার তুলনায় প্রায় ৪০ লাখ টন বেশি হয়েছিল। ফলে দাম পড়ে যায়। মাঠপর্যায়ে কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য পাননি। তাই অনেকেই এখন আর আগ্রহী নন। এ কারণে এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও বাড়ানো হয়নি।’
আলু মাটির নিচে জন্মায়, তাই একে বলা হয় ‘মাটির নিচের ফসল’। কিন্তু নানা রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণে অনেক আলু মাঠেই নষ্ট হয়। আলুর রোগ হয় গাছের পাতা, কাণ্ড, চারার অঙ্কুর ও মাটির নিচের কন্দে।
চট্টগ্রামের কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সবচেয়ে ক্ষতিকর রোগ হলো লেট ব্লাইট। এ রোগে পাতা কালচে হয়ে যায়, পরে গাছ শুকিয়ে যায়। আর্লি ব্লাইটে পাতায় বাদামি দাগ পড়ে। লিফ কার্ল ভাইরাসে পাতা কুঁকড়ে যায়, গাছ খর্বাকৃতি হয়ে পড়ে। ফলে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এ ছাড়া কাটুই পোকা আলু কেটে নষ্ট করে। স্থানীয় জাতের আলুতে এসব রোগবালাই তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়।
চন্দনাইশ উপজেলার হাজিরপাড়া গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ মুছা জানান, তাঁর গ্রামে এখন আর দেশি লাল আলুর চাষ তেমন হয় না। একসময় দেশি লাল আলুতে ভরা থাকত মাঠ। এক গন্ডা জমিতে ছয়-সাত মণ আলু পাওয়া যেত। ২০১৪ সালের দিকে হঠাৎ দেখা গেল, পাতাগুলো কুঁকড়ে যাচ্ছে, গাছ বড় হচ্ছে না। ফলনে ধস নামে। তার পর থেকে দেশি আলুর চাষ ক্রমাগত কমতে থাকে।
স্থানীয় কৃষকেরা জানান, ভাইরাসের কারণে দেশি আলুর গাছ দুর্বল হয়ে যায়, কন্দ ছোট হয়। আলুর আকার ছোট হলে বাজারে দাম পাওয়া যায় না। তাই অনেকেই দেশি জাত বাদ দিয়ে বিদেশি বা উন্নত জাতের দিকে ঝুঁকছেন। চন্দনাইশের কৃষক আবু মুছা বলেন, ‘সব মিলিয়ে এক কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়ে ২০ থেকে ২২ টাকা। কিন্তু গত মৌসুমে ওই দামে বিক্রি করতেও পারিনি। তাই এবার আর আলু চাষ করব না।’
চট্টগ্রামে আলু একসময় ছিল লাভজনক ফসল। এখন সেটি কৃষকের কাছে হয়ে উঠছে অনিশ্চয়তার প্রতীক। ফলন কমছে, খরচ বাড়ছে, দাম পড়ছে। কৃষকেরা ধীরে ধীরে মাঠ থেকে সরে যাচ্ছেন। ফলে মাটির নিচের এই সোনালি ফসল যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা প্রণব নাথ আলু চাষে হিমশিম খাচ্ছেন। মোটাদাগে তিনটি কারণ তিনি জানিয়েছেন। এগুলো হলো ফলন কমে যাওয়া, আলু পচে যাওয়া, দাম কম পাওয়া। প্রণব নাথ সত্যের পথেকে বলেন, গত মৌসুমে ২০ শতক জমিতে আলুর চাষ করেছিলেন। খরচ হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু সব টাকা উঠে আসেনি। ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, পাঁচ বছর ধরে চট্টগ্রামে আলুর আবাদ ও উৎপাদন দুই-ই কমছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৪১ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ৬৪ হাজার ৬৮৫ টন। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ৩ হাজার ৬৮৩ হেক্টরে, উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৪৯৯ টনে; অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে জমি কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ ও উৎপাদন কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, জেলায় মোট আবাদযোগ্য জমি ২ লাখ ২৮ হাজার ২৯০ হেক্টর এবং কৃষক পরিবারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ। এর মধ্যে দেড় লাখ পরিবার ভূমিহীন। কৃষকেরা তিন মৌসুমে ফসল চাষ করেন—রবি, খরিফ-১ ও খরিফ-২।
রবি মৌসুম (১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ) হচ্ছে আলু চাষের সময়। এ মৌসুমে বোরো ধান, শীতকালীন সবজি, ভুট্টা, গম, তেল ও ডালজাতীয় ফসলের পাশাপাশি নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে কৃষকেরা আলুর বীজ মাটিতে রোপণ করেন।
অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘একই জাতের বীজ বারবার ব্যবহার করার কারণে ফলন কমে যাচ্ছে। রোগবালাইয়ে নষ্ট হচ্ছে আলু। চট্টগ্রামের কৃষকেরা অপরিপক্ব বীজ ব্যবহার করেন। আমরা পরামর্শ দিই—এক বছর বিরতি দিয়ে চাষ করতে এবং সার-বীজ ব্যবস্থাপনায় বৈচিত্র্য আনতে। কিন্তু অনেকেই পরামর্শ না মেনে উৎপাদন করে লোকসান গুনছেন।’